শাড়িতেই নারী : Saree for Women

Saree for Women : কথাতেই আছে, শাড়িতেই নারী সম্পূর্ণ। তাই কোন শুভ অনুষ্ঠানে নারীদের প্রথম পছন্দ শাড়ি। হাজারো জাঁকচমকপূর্ণ পোশাকের ভিড়েও শাড়ি কিন্তু অতুলনীয় জায়গা করে রয়েছে। আর বর্তমানে তো শাড়ির প্রকারের কোন শেষ নেই, বিভিন্ন রং- এর বিভিন্ন কাপড়ের শাড়ি। আজকে তাহলে এই শাড়ি সম্পর্কে কিছু ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক-
নানা জ্ঞানীজনের মতে সংস্কৃতের ‘সত্তিকা’ থেকেই শাড়ি শব্দের প্রবর্তন হয়েছে। এই সত্যিকার শব্দের অর্থ হলো কাপড়ের টুকরো যা এখন আমরা সবাই শাড়ি বলেই জানি। এছাড়াও অনার্য সভ্যতায় ‘শাটী’ শব্দের প্রচলন ছিল তাই অনেকেই মনে করেন যে এই ‘শাটিই’ শাড়ির মূল শব্দ। তাছাড়া মহাভারতেও এই শাড়ি সম্পর্কে একটি বিরাট প্রমাণ মিলে যেখানে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হয়েছিল, সেটাও শাড়ি ছিল বলে মনে করা হয়।

শাড়ির ইতিহাস (History of Saree) :

ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে শাড়ি (Saree) প্রায় ৫৫০০ বছর আগে আর্যরা প্রচলন শুরু করেছিল। আরো দেখা যায় সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে নারীরা শাড়ি পরিধান করে আছে। এখান থেকে বোঝা যায় ভারতে অনার্যরা সেলাই জানতো না তাই মহিলা পুরুষ সকলেই বস্ত্র হিসাবে শাড়ি পরিধান করত। পুরুষদের এই পরিধান শাড়ি আজ ধুতি উত্তরীয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় এমনই বলেছেন যে, পূর্ব দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের মানুষরা সেলাই জানত না বলে এরা অখন্ডবস্তু পরিধান করে থাকতো। যেটা পুরুষরা পরিধান করলে হতো ধুতি আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটাই হলো শাড়ি (Dhoti saree for women)।

এখানে মহিলা এবং পুরুষ উভয়েরই শরীরের উপরের অংশ উন্মুক্তই থাকতো। তবে কোনো পার্বনের ক্ষেত্রে উচ্চ বংশের নারীরা নিজেদেরকে ওড়না জাতীয় কাপড়ে ঢেকে রাখতো। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা যে সমস্ত জায়গার কথা উল্লেখ করে গেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগটাই হল আজকের ভারতের পশ্চিমবাংলা, উড়িষ্যা কেরালা, কর্ণাটক, আসাম, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, অন্ধপ্রদেশ ,গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব এবং আজকের বাংলাদেশ।
তাই অবশ্যই বলা চলে যে শাড়ি শুধুমাত্র নারীদের পোশাক নয়, তবে বর্তমানে নারীরাই বিশেষ করে এই পোশাক পরিধান করে।

শাড়ির ঐতিহ্য এবং বিবর্তন

গুপ্তযুগে কবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এ শাড়ির কথা আছে। এছাড়াও ইলোরা অজন্তার গুহার গায়ে যে প্রাচীন চিত্র আছে সেগুলিও প্রমাণ করে যে খ্রিস্টাব্দ শুরু হওয়ার আগে থেকেই শাড়ি উল্লেখযোগ্য ছিল। এছাড়াও আরো বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে হাজার হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির চলন বেশ ভালই ছিল। তবে তখনকার দিনে শাড়ি পরার ধরন এখনকার মত ছিল না হয়তো।
ভারতবর্ষে যখন মুসলমানদের আগমন হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায় ,তখন শাড়ির উপর আভিজাত্যের ছোঁয়া পরে। এবং এরপরেই দেখা যায় দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের মহিলারা তাদের প্রধান পোশাক হিসেবে শাড়ি কেই বেছে নিয়েছেন। এবং এটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন রকম ভাবে শাড়ি পরার ধরন তৈরি হয়। তবে যখন থেকে সেলাই করার প্রবর্তন আসে তখন থেকেই শাড়ি পরার ধরনের প্রচুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এভাবেই আস্তে আস্তে নারীদের বক্ষাবরণের উপরে শাড়ি স্থান পায় এবং এটা আস্তে আস্তে মাথার ওপরেও স্থান পায়। সেলাই শিল্প প্রবর্তন হওয়ার পর নারীরা ব্লাউজ ব্যবহার করতে শুরু করে।

এখানে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর বাড়ির কথা বলতেই হয়। যেখান থেকেই শুরু হয় কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা। প্রথমে কুঁচিটা সামনের দিকে প্রস্ফুটিত ফুলের মত করে পড়া হত। পরে সেটাই বড় একের পর এক ভাঁজ দিয়ে সুবিন্যস্ত করা হয়। ঠাকুর বাড়ির বউ জ্ঞানদানন্দিনী, পার্সি কায়দায় কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা শুরু করেন। যেটাই এখন প্রায় সকল মহিলারা পরিধান করে থাকে।

শিল্প বিপ্লবের আগে বাংলাদেশ-ই ছিল পৃথিবীর সবথেকে বড় বস্তশিল্প কেন্দ্র। ঢাকা, রাজশাহী, নোয়াখালী, সোনারগাঁও, কুষ্টিয়া, খুলনা, কুমিল্লা এগুলি সমস্তই প্রায় বস্ত্র শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল। ঢাকা এবং সোনারগাঁয়ে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমী উৎপাদিত হতো বলে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশের মুসলিম এবং জামদানির নাম ছিল গোটা পৃথিবীজুড়ে। রেশমি বস্ত্র বাংলায় সুতি বস্ত্রের মতোই বিখ্যাত হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশের ঢাকাতে আরো নানা ধরনের কাপড় বানানো হতো। এখানকার বিভিন্ন টেলার এর মতে ১৯৮০ সালে যখন বস্তশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়, তখনও একমাত্র ঢাকাতে ৩৫ রকমের কাপড় তৈরি করা হতো। বিভিন্ন যান্ত্রিক কার্যকলাপের ব্যবহার এবং আরো জটিলতার কারণে এই তাঁত শিল্প আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।

মহিলারা যেভাবে শাড়ি পরিধান করে থাকে (Saree for Women)

বিভিন্ন গ্রন্থে শাড়ি পড়ার প্রায় আশিটিরও বেশি প্রকার পাওয়া যায়। শাড়ির একপ্রান্ত কোমরে পেঁচিয়ে অপর প্রান্তটি কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে ঝুলিয়ে পড়া হত। বিভিন্ন গ্রন্থে গুজরাট গোয়া মহারাষ্ট্র কেরালা কর্ণাটক অন্ধ্রপ্রদেশ ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ তামিলনাড়ু মধ্যপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ মোট ১৪ টি রাজ্যের শাড়ি পরিধানের পদ্ধতি বলা হয়েছে।

বিভিন্ন পেশার মানুষরাও এই শাড়ি ব্যবহার করে থাকে

ভারতের তাপমাত্রা অধিক হওয়ার কারণে শাড়ি একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। এটি কেবলমাত্র যে শীতে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মের শীতল করে তাই নয়, এটি পরিধান করার পদ্ধতিটি ঢিলেঢালা হওয়ার জন্য মহিলাদের খুবই পছন্দের তালিকায় থাকে। ভারত বাংলাদেশ, শ্রীলংকা সহ দেশের বিমান ওয়ালারা তাদের ইউনিফর্ম হিসাবে এই শাড়িকে বেছে নিয়েছেন। শাড়ি এই দেশের ঐতিহ্যবাহী হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

[ আরো পড়ুন : পুরুষের প্রথম পছন্দ পাঞ্জাবি : Panjabi for Men, Panjabi Design ]

এছাড়া ভারতের সংস্কৃতির পথিক হিসেবে শাড়ি ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলের মহিলারা তাদের ইউনিফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও এখানকার মহিলা রাজনীতিবিদরাও শাড়ি পড়ে থাকেন। ইন্দিরা গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধী মতো মহিলারা বিশেষ ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি ব্যবহার করে থাকতেন।

বিভিন্ন রকমের শাড়ি

কিছু বিশেষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বানানো শাড়ি ছাড়াও আধুনিক ঘরানার শাড়ি এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই তাদের নিজস্ব ভাবনার তৈরি শাড়ি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের এবং বিভিন্ন মানের শাড়ি তৈরি করা হয়। জামদানি, কাতান, রাজশাহী সিল্ক(Tussar Silk Saree), মনিপুরী শাড়ি, বালুচরী শাড়ি, ঢাকাই শাড়ি ইত্যাদি শুধু দেশে নয় বিদেশেও মানুষের খুব পছন্দের কিছু শাড়ি।

এখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন মেহেন্দি অনুষ্ঠান, হলুদ অনুষ্ঠান, বৌভাত প্রভৃতিতেই এরা শাড়ি ব্যবহার করে থাকে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের কোণে কে মূলত বেনারসি শাড়ি পড়ানো হয়ে থাকে। আমাদের দেশে একটি রীতি প্রচলিত আছে এদের হলুদ অনুষ্ঠানে ছেলেপক্ষ এবং মেয়ে পক্ষরা, দুজনেই একই রংয়ের অথবা দুজনে পৃথক রঙের শাড়ি পড়ে নিজেদেরকে সাজায়। এদের ঈদুল ফিতর, শবেবরাত ইত্যাদি ধর্মীয় কিছু উৎসবে এরা ধবধবে সাদা হালকা এবং ধূসর শাড়ি পরে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কারুকার্য খচিত বিভিন্ন শাড়ি পড়ার রেওয়াজ আছে। তবে এখানে বাংলা নববর্ষে লাল পাড়-সাদা শাড়ি পরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বাংলাদেশে একটা অন্যতম অনুষ্ঠান একুশে ফেব্রুয়ারি কালো পাড়ের শাড়ি তারা পড়ে থাকে।
ভারতবর্ষেও শাড়ি পরার রীতি অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে। এবং বর্তমানেও শাড়িই ভারতবর্ষের মহিলাদের প্রথম পছন্দ। এখানে প্রচুর রকমের শাড়ি পাওয়া যায় তার মধ্যে খুবই জনপ্রিয় কিছু শাড়ি ঢাকায়, বেনারসি, বোমকায়, কাঞ্জিভরম (Kanjivaram Saree), চান্দেরি, বালুচড়ি।

ভারতে একটি বিশেষ শাড়ি পাওয়া যায় যার নাম পৈঠানি (Paithani Saree)। এটি মূলত মহারাষ্ট্রের একটি শাড়ি। পৈঠানি হলো মূলত সিল্কের শাড়ি।

এছাড়াও পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় মানুষজন এখনো শাড়ির ব্যবহার রেখেছে। সেখানে মূলত পাকিস্তানের হিন্দু নারীরা প্রতিদিনের পোশাক হিসেবে শাড়ি ব্যবহার করে থাকে।

আমাদের সংস্কৃতির ধারক এই শাড়ি। আমরা মূলত বারো হাত শাড়ি কথাই বেশি শুনি। এছাড়া বোননের শাড়ি নকশা শাড়ি ইত্যাদি বাঙ্গালীর পোশাক ভাবনাকে আলাদা জায়গায় এনে দিয়েছে। সালোয়ার কামিজের পরিধান করার সহজ পদ্ধতি এবং বিদেশি পোশাকের সহজতার ভিড়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি যেন কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছে, দেশের তাঁতিরা তাদের তাঁত বোনা প্রায় বন্ধ করেই ফেলেছে, তাই হয়তো দেশের সেই ঐতিহ্যতম দিনগুলো কি হারিয়ে যাবে? তবে আমাদের ঐতিহ্য আমাদেরকেই ধরে রাখার অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

1 thought on “শাড়িতেই নারী : Saree for Women”

Leave a Comment